সুন্দরবনের জঙ্গলেই পরিচিত এক প্রতিক্রিয়া – এত ঘুরলাম, খুঁজলাম, কিন্তু বাঘ কই ? বাঘ দেখা তো অনেক দূরের কথা, বাঘের ল্যাজটুকু দেখতে পেলাম না যে !
বন্যপ্রাণ পর্যটনের প্রবল চাহিদা বাঘ। বাঘকে ঘিরে বন্যপ্রাণ পর্যটনের বার্তা, অথচ সুন্দরবনের জঙ্গলে তার দেখা তো সহজ না ! খুঁজতে খুঁজতে ব্যর্থতা আসে প্রায়ই, রাগে দুঃখে নিরুপায় গাইড সাহেব বা সারেঙ সাহেবকে প্রায়ই অনুযোগের স্বরে বলে ওঠে বাঘপ্রেমী – অন্তত একটা ল্যাজ দেখিয়ে দাও, আর কিছু দেখা যাক না যাক !
বাঘের মুখ, হাত, গা, চোখ, গোঁফ তার ভয়ঙ্করতা, হিংস্রতার প্রতীকস্বরূপ। তা নিয়ে অভিজ্ঞতা, লেখা, ছবি সবই হিংস্র, সুন্দর। কিন্ত তার ল্যাজ ? ল্যাজের আপাত নিরীহতা থেকে লেখায়, ছবিতে তার ধারণা বরং অনেক বেশি মোলায়েম।
এই মুহূর্তে মনে পড়ে যায় বাঘের ল্যাজ নিয়ে মাইক বোল্টের লেখা ‘ A Tiger’s Tail’ কিংবা স্কুল পাঠক্রমে থাকা ভোলা ঠাকুরদার গল্পের কথা। সুন্দরবনের পটভূমিকায় লেখা সে বিবরণে বিপত্তি ঘটে এক ঝড় বদলের রাতে, পোষা গরু ভেবে বাঘকে আনা হয় গ্রামে, ঘটে একের পর এক অদ্ভুত ঘটনা।
আজকের লেখা তার ল্যাজ নিয়ে। দেখে নেওয়া যাক বাঘের ল্যাজ :
*****
বাঘের ল্যাজ গড়ে তিন ফুট মতো লম্বা হয়। স্বজাতির সাথে তার যোগাযোগের ক্ষেত্রে ল্যাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাঘের ল্যাজের ডগা কালো, খুঁটিয়ে দেখলে গায়ের স্ট্রাইপ বা ডোরার পাশে ল্যাজের রিং সহজেই চোখে পড়ে যায়।
বাঘের ল্যাজের ব্যবহার নানাবিধ – ল্যাজের নড়াচড়া থেকে তার মনের অবস্থার কথা জানা সম্ভব। এছাড়া সেই মুহূর্তে তাদের মুড বা মেজাজ, মেটিং বা প্রজননকালের রীতিতে ল্যাজের ভূমিকা ও ব্যবহার চমকপ্রদ। সামাজিক বন্ধন বা সোশ্যাল বন্ডের ক্ষেত্রে বাঘ – বাঘিনী , মা – বাচ্চার সম্পর্কে ল্যাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া চলাচল, সাঁতারেও বাঘের বিশ্বস্ত অস্ত্র হয়ে ওঠে তার ল্যাজ। মানসিকতার মতোই, চেহারার একাধিক বিশেষ বৈশিষ্ট্যে সুন্দরবনের বাঘ ভারতের অন্য বাঘবনের থেকে কিছুটা ভিন্ন। বাকি শরীরের মতোই, জলকাদার দেশে তার ল্যাজের গঠন, ভূমিকা কিভাবে অন্যরকম – তা বিস্ময়কর।
বাঘের ল্যাজের আরেক ব্যবহার মাছি তাড়ানোর, অর্থাৎ তার ল্যাজ এক প্রকার fly swatter এর কাজও করে। কাঁচা মাংস, ফেলে রাখা পচন ধরা মাংসের কাছে, পাশে বাঘের অবস্থান, আনাগোনা দেখা যায়। ফলে, তার সাথে সাথেই আসে মাছির দল – খাদ্যে, মুখে, গায়ে ভনভন করতে থাকা মাছি তাড়ানোর জন্য ল্যাজের জুড়ি নেই। সুন্দরবনের বাইরে বাঘের জঙ্গলে, শিকারের কাছেই ঘুরঘুর করতে থাকা বিভিন্ন স্ক্যাভেঞ্জারদের সতর্ক করার জন্যও ল্যাজের দ্রুত ঝাপটা দিতে দেখা যায় বাঘকে।
প্রজননকালে বাঘের জোড়া লাগলে, একেকটা পর্বে দিনে একাধিকবার মিলিত হয় বাঘা – বাঘিনী। সম্ভাব্য সঙ্গীর খোঁজ পেলে ঘনিষ্ঠ হয় বাঘযুগল। এই সময়ে সঙ্গীর গায়ের কাছে আসা, সঙ্গীর গায়ে ল্যাজের আলতো টোকা বা ‘ফ্লিক’ হয়ে ওঠে বাঘের স্বল্প-জানা, রহস্যে মোড়া এই অধ্যায়ের কোমল, আবেগঘন মুহূর্ত।
খাল খাঁড়ি সাঁতরে পেরোবার সময় বাঘ তার ল্যাজ ব্যবহার করে জলের স্রোত বোঝার চেষ্টা করে। এছাড়া, ঘন কাদায় উঁচু পাড় ওঠার সময়ে তার ল্যাজ শরীরের ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে। স্বল্প উচ্চতার গাছে কিছুটা দূর চড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও ল্যাজ হয়ে ওঠে এক রেডার। দিক বোঝা , ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ল্যাজের ব্যবহার বাঘ ও সমগোত্রীয় অন্য বড়ো ক্যাটদের মধ্যেও দেখা যায় ও তাদের প্রত্যেকের জাতিগত বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো।
বাঘ একা শিকার করে। ধরা হয়, তার strike rate গড়ে দশে একবার। স্ট্রাইক রেট অর্থাৎ কতবারের প্রচেষ্টায় সে একবার শিকার ধরতে সক্ষম হচ্ছে।বাদাবনের বাঘের ক্ষেত্রে শিকার ধরার প্রক্রিয়া আরো কঠিন।কাদামাটি,ঘন বন,কাঁটা,শুলো জোয়ারভাঁটা – সবই নির্ধারক কারণ হয়ে দাঁড়ায়।শিকারের কাছে এসে অন্তিম লগ্নে গতির বৃদ্ধি বা burst দিয়ে শিকারের দিকে কাছে চলে আসে যখন , শিকার পালাবার চেষ্টা করে। শিকারের সাথে সাথে শিকারির দ্রুত দিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ল্যাজ শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখে।
পায়ে পায়ে সুন্দরবনের জঙ্গলে কাজের অর্থ, বাঘের খুব কাছে চলে আসা। বনজীবী ও বনকর্মী অভিজ্ঞতায় মাঝেমাঝেই খুব কাছ থেকে বাঘ সাক্ষাৎ ঘটে যায়। মানুষ আয়ত্তে আছে বুঝলে অথবা শিকারে বসা বাঘের ক্ষেত্রে অন্তিম চার্জের আগে সেই ল্যাজ দুলতে থাকে, ঘনঘন ল্যাজ নাড়ানো ও দোলানো ও সাথে পেছনের দুই পা দিয়ে মাটি খুবলে তুলে ফেলা একাধিক বাঘ – মানুষ সংঘাতে প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখে থাকেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনাবলী অতি দ্রুত, সাথে তা অন্তিম পরিণাম নিয়ে আসে।
এলাকা টহল, সঙ্গী খোঁজের সময়ে গাছের, ঝোপের গায়ে তার ঘনঘন গা ঘষা, পাক খাওয়ার বর্ননা পাওয়া যায় ট্র্যাপ ক্যামেরার সন্ধানে, এমনকি বনজীবী, বনকর্মী অভিজ্ঞতায়। বেড়ালের মতোই তার ল্যাজের ব্যবহার তখন, গাছের গায়ে ল্যাজ পাকানো, জড়ানোর মাধ্যমে বাঘ দেয় বা খুঁজে নেয় জরুরি তথ্য, বার্তা।
আর ভ্রমণ নৌকার ক্ষেত্রে ? ডাঙায় বাঘের অতিরিক্ত কাছে অনেক সময়ই উৎসাহী ছবি সন্ধানীরা পৌঁছে যান, নৌকা অধিনায়করাও কখনো কখনো তা রোধে ব্যর্থ হন – ফলাফলে, অনেক সময় দেখা যায় বাঘ তার বিরক্তি, এমনকি প্রস্তুতিও জানান দিয়ে যায় সিধে, কাঁপতে থাকা ল্যাজের মাধ্যমে। জলে সাঁতারের সময় দেখা বাঘের ক্ষেত্রে উত্তাল জল বা স্রোতের বিপক্ষে সাঁতরানোর সময় সেভাবে দেখা না গেলেও তার কাছে চলে আসা নৌকা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় ল্যাজ শুধুই তার শরীরের অঙ্গ নয়, তার চলাচলের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক
অস্ত্র।
আজ থেকে এক দশক আগে একদিন হঠাৎ আমাদের সামনে এক বিখ্যাত বাঘ পড়ে যায়। মেল টাইগার, আগ্রাসন তার চলনে, তাকানোয়। হঠাৎ মুখোমুখি হই আমরা, দূরত্ব সামান্যই। পারাপারের পথে এমন অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ বাঘের সাথে আমাদেরও অবাক করে। আজও চোখ বুজে ভাবলে, কয়েক হাত দূর থেকে সেই মুহূর্তে দেখা তার ল্যাজের দোল মনে পড়ে যায়।
এবারের ছবির নিবেদন রেখেছেন বিশিষ্ঠ বন্যপ্রাণনৌকা অধিনায়ক Subal Gayen । বাঘ ও অন্য বন্যপ্রাণের খোঁজে জঙ্গলে তার সারা বছর কাটে, অতিথিদের জন্য সহজ করে তোলেন তাদের দেখা, জঙ্গল বোঝা।

লেখক: উদ্দালক দাস