হলুদ / কালো, কমলা/কালোর ডোরা তার গায়ে, সম্মানার্থে তাকে বলা হয় স্ট্রাইপড লর্ড অফ দা ম্যানগ্রোভস, বা বাদাবনের রাজা। জঙ্গলের অধিবাসীরা তাকে কেমন দেখে ? তা আমরা আন্দাজ করতে পারি বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ দিয়ে। আর মানুষ ? জঙ্গলজীবী, বনকর্মীদের সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে আসে বাঘের নানা রং, নানা চেহারা, নানা রূপ।
আছে লোকমুখে কথিত লাল বাঘ, কমলা বাঘের কথা – যাদের গায়ের রং উজ্জ্বল। আছে কাদা মাখা কালো বাঘ, বৃদ্ধ ‘জটা’ বাঘ বা গায়ের রং ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া প্রবীণ বাঘ। জঙ্গলের পথে, কাছে দূরে বিভিন্ন সময়ে বাঘের সাক্ষাৎ থেকেই উঠে আসে চেহারা ও রঙের তারতম্যের কথা। সাক্ষাৎ দূরত্ব, বিশেষত সংঘাতহীন সাক্ষাৎ হলে বর্ণনা আরো নিপুণ হয়, সংঘাত মুহূর্তের বিবরণ অনেক সময় আংশিকভাবে সঠিক হয়। তবে এটা বলা যায়, আমাদের বাদাবনের বাঘের রং মেইনল্যান্ডের বা মূল ভূখণ্ডের বাঘেদের থেকে আরো বেশি উজ্জ্বল।
আজকের আলোচনায় বাঘের খাদ্য বা প্রের কাছে বাঘের গায়ের রং। দেখে নেওয়া যাক বিশদে :
*******
বাঘেদের গায়ের রং হলুদ বা কালো কেন ? খুব সহজ করে বললে, সুন্দরবনের জঙ্গলে বাঘের দুই প্রধান খাদ্য হরিণ ও শুয়োর dichromats, অর্থাৎ তারা চোখ দিয়ে দুটো রং দেখতে পায়। আমাদের চোখে বাঘের কমলা / হলুদ যে রং ধরা পড়ে, তা তাদের চোখে সবুজ হয়। এর ফলে বাঘ তার স্বাভাবিক camouflage বা আড়াল হওয়ার রং পেয়ে যায়, শিকার ধরতে পারে।
বাঘ ও অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীর dichromatic vision – তাদের চোখে নীল ও সবুজ এই দুই রঙের cone আছে। ফলে, তারা লাল, সবুজ শেডের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। মানুষের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য যাদের থাকে, তাদের কালার ব্লাইন্ডনেস বা রঙের ঘাটতি বা colour deficiency দেখা যায়।
Dichromacy শব্দের উৎপত্তি গ্রীক ‘ di’ বা দুই ও chromo বা রং থেকে। কোন সেল নামক দুই ধরনের ফটোরিসেপ্টর dichromat প্রাণীদের চোখে থাকে। দুই প্রাইমারি রং দিয়ে তাদের visible gamut নির্ধারিত হয়।
প্রাণীদের colour perception , খাদক বা খাদ্যের উভয়ের জন্যই নির্ধারিত হয় চোখের ফটোরিসেপ্টর সেল দ্বারা। বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীর দুই না তিনরকম কোন থাকে ( photoreceptor cells ) যা বিভিন্ন ওয়েভলেংথের আলোয় সংবেদনশীল। এবং তা দিয়েই, রঙের স্পেকট্রাম অনুভব করতে পারে তারা।
আমাদের চোখের vision trichromatic, অর্থাৎ লাল, হলুদ ও নীল – এই তিন রঙের base বা ভিত্তির মাধ্যমে অন্য রঙের শেড বা মিক্স দেখি। বেশিরভাগ বড়ো তৃণভোজীরা dichromatic, হলুদ ও নীল রঙের শেড ও মিক্স তাদের চোখে ধরা পড়ে। বাঁদর গোষ্ঠীর সদস্যরা, marsupial রাও আমাদেরই মতো – তারা trichromatic । পাখি, মাছেদের চোখে চারটে কালার কোন থাকে।
বাইরের আলো যখন আমাদের মানুষদের চোখে পড়ে, তা চোখের রেটিনায় গিয়ে ধাক্কা খায়। রেটিনা সেই আলো প্রসেস করে দু রকম আলোর রিসেপ্টর দিয়ে – রড ও কোন। রড শুধুমাত্র আলো অন্ধকারের মধ্যে তারতম্য করতে পারে, রঙের নয়। রডের ব্যবহার সাধারণত অল্প আলোয় হয়ে থাকে। কোন এর মাধ্যমে কালার পারসেপশন করা যায় । মানুষের তিনরকম কোন থাকে – নীল, সবুজ আর লাল। সেই কারণে আমাদের ভিশন trichromatic – তিন প্রাইমারি রং ও তাদের কম্বিনেশন আমাদের চোখে ধরা পড়ে।
মানুষের চোখে তিন রকমের কোন সেল, প্রত্যেকটির একটি করে ভিন্ন ফটোপিগমেন্ট ( opsin) থাকে, যা বিভিন্ন ওয়েভলেংথের আলোয় সংবেদনশীল।
S Cone ( ছোটো ওয়েভলেংথ ) নীল আলোয় সেনসিটিভ, M Cone ( মাঝারি) সবুজ আলোয় ও L Cone ( লম্বা) লাল আলোয়। colour vision এর ‘trichromatic theory’ Young – Helmholtz থিওরি হিসেবে পরিচিত। যে কোনো রঙের পারসেপশন তিন রকম কোন সেলের প্রাপ্ত সিগন্যালের কম্বিনেশন। তাদের সংযুক্তিকরণ দিয়ে মস্তিষ্ক রঙের রেঞ্জ অনুভব করতে পারে। প্রাইমেটদের foraging বা খাদ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ফুল, ফল বা পাতা distinguish করা বা পৃথকভাবে চেনার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে।
ইন্ডিভিজুয়াল তারতম্য ঘটে যখন মানুষ dichromatic হয় ( একটা কোন টাইপ থাকে না ) অথবা anomalous trichromacy ( তিনরকম কোন থাকে, তবে একটি less sensitive থাকে ) দেখা যায়।
ঠিক এই কারণে ঘন বনের, শুলো, কাঁটার বাদাবনের দেশে বাঘের শিকারে বসা বা ambush করা ঘটে যায় তাদের অলক্ষ্যে। কমলা বা হলুদ রং তাদের চোখে ধরা পড়ে না, শিকারি আগমন বোঝার জন্য তাদের গন্ধ, শব্দে নির্ভর করতে হয়। জঙ্গলের পথে এমন অভিজ্ঞতা আমার ও আরো অনেকের হয়েছে নিশ্চয়ই – যেখানে হরিণ এলার্ম কল দিচ্ছে বা ঘনঘন সম্ভাব্য আক্রমণ কেন্দ্রের দিকে তাদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করা, সজাগ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তারা খুঁজে নিতে চায় বাঘের আনাগোনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ঘাস, রিড এর তফাৎ তারা সহজে করে উঠতে পারে না।একইভাবে, শুয়োরের ক্ষেত্রেও এমন দেখা যায় – বাঘ দেখা না গেলেও দ্রুত এদিক ওদিক তাকানো, ল্যাজ নাড়া বা হঠাৎ ছুটে পালানোর মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় তল্লাটে বড়ো বাবুর উপস্থিতির কথা।
বাঘ ambush predator , লুকিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ পদ্ধতি অবলম্বন করে সে। আলো ছায়ার বাদাবনে তার গায়ের ডোরা নিমেষে মিশে যায় পারিপার্শ্বিকে, এই invisibility বা দৃশ্যমানতার অভাব না থাকলে তার স্ট্রাইক রেট ( কতগুলো প্রচেষ্টায় একটা সফল শিকার ) নিম্নগামী হতো আরো, তা বলা যায়।
বাঘ ও তার খাদ্য অর্থাৎ হরিণ বা শুয়োর কেউই কমলা , সবুজের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। ফলে , হরিণের মতো প্রাণীর ক্ষেত্রে কোনো বাঘের হাত থেকে লুকোনোর জন্য সবুজ ফার বা লোম চামড়া বিবর্তনের evolutionary pressure আসেনি।
ডাইক্রোম্যাটিক ভিশনের কারণে খাদ্য প্রাণীরা বাঘের কমলা/ হলুদকে আরো muted বা চাপা শেডে দেখে, সম্ভবত যা সবুজ স্পেকট্রাম ঘেঁষা হয়। সুন্দরবনের ঘন আঠালো গাছপালার পরিবেশে বাঘের গায়ের রং চারপাশের সবুজের সাথে মিলে যায়, তাতে একটা সবজে hue বা শেড আসে।
ডাইক্রোম্যাসির ভাগগুলোর মধ্যে থাকে – Protanopia ( L cone ঘাটতি, লাল সবুজে পার্থক্য করার সমস্যা হয় যাতে ), Deuteranopia:( M cone ঘাটতি, এতেও লাল ও সবুজে পার্থক্যে সমস্যা হয়) ও Tritanopia ( S cone এর ঘাটতি থাকে, নীল ও হলুদে পার্থক্য করতে অসুবিধা হয় ) । dichromat দের saturated রঙের মধ্যে পার্থক্য করতে বা রঙের বিভাজন ( colour discrimination ) আছে এমন কাজ সম্পন্ন করতে সমস্যা হয়।
ঠিক এই কারণে সাদা বাঘের প্রাকৃতিকভাবে টিকে থাকা, খাদ্য সংগ্রহ করা শক্ত হয় – খাদ্যের চোখে সে সহজে ধরা দেয় প্রকৃতির নিয়মে। গায়ের রং ও প্যাটার্ন দিয়ে প্রাণীরা স্বজাতির সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে খাদককে নিজের toxicity বা বিষাক্ততার বার্তা দেয়। এরই মাঝে বাঘ বা অন্য খাদকদের অদৃশ্য থেকে খাদ্য যোগাড় করে নিতে হয় ; অসফলতার মেয়াদ অবধি থেকে যায় অভুক্ত থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা।
খাদক / খাদ্য, শিকারি / শিকারের মধ্যে এই visual difference বা তফাৎ বিবর্তনগত adaption এর এক উদাহরণ। বাঘ যেমন তার ক্যামোফ্লাজের সাহায্য নেয়, শিকার বা খাদ্য তার ভিশন বা দৃষ্টিশক্তি দিয়ে সম্ভাব্য বিপদ এড়িয়ে চলে।
আমরা এর থেকে বুঝি, রঙের পারসেপশন বা বোধ universal বা সামগ্রিক নয় – প্রাণীর চোখের গঠন ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে তা নির্ধারিত হয়।
*******
* এবারের বাঘের ছবির নিবেদন রেখেছেন সুন্দরবনের প্রিয় ও সম্মানীয় জঙ্গুলে Anirban Ganguly । তিনি সুন্দরবন ও বিভিন্ন বাঘবনের পরিচিত মুখ। তাঁর তোলা ছবিতে দেখি জঙ্গলের বহু অসাধারণ ঘটনাপ্রবাহ, বাঘের অসামান্য নানা মুহূর্ত।
Comment (0)