বাঘের দাঁত
বাঘের দেখা বা বাঘের ছবি,ভিডিওর জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত।অপরূপ সুন্দর এই এপেক্স প্রেডেটরকে ঘিরে মানুষের আগ্রহ,কৌতূহল অপরিসীম।
আজকের লেখার বিষয় বাঘের দাঁত।
******
স্টেলথ শিকারি বা লুকিয়ে, সন্তর্পণে শিকার করে বাঘ, নিজের শরীরকে দূর্দান্তভাবে ক্যামোফ্লাজ করে। দাঁত, চোয়ালের পেশী, জোরালো হাতার সাহায্যে সে হয়ে ওঠে এক অসাধারণ শিকার যন্ত্র। শিকারকে ধরে চামড়া, লোম, হাড়, পেশী ছাড়িয়ে নূন্যতম অপচয় করে সহজেই শিকার ভক্ষণ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে তার দাঁত এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সংরক্ষিত হয় তার এনার্জি গ্রহণ, পরবর্তী শিকার অবধি চিন্তার কিছু থাকে না।
******
জন্মানোর সময়ে বাঘের শাবকদের দাঁত থাকে না। দু সপ্তাহ পরে দুধের দাঁত বেরোয়, এক সময়ে তা পড়েও যায়। পরিবর্তে আসে মিল্ক টিথের ঠিক পেছনের সারিতে থাকা পার্মানেন্ট বা চিরস্থায়ী দাঁতের পাটি। মানুষের মতো পার্মানেন্ট দাঁতের পাটি দুধের দাঁত সরিয়ে দেয় না, বরং মাস ছয়েক বয়স থেকে তার পাশে গঠিত হতে থাকে। ফলে, এক পাটির পরিবর্তে আসে আরেক – বাঘকে দাঁতহীন বা টুথলেস থাকতে হয় না।
পূর্ণবয়স্ক বাঘের ৩০টা দাঁত থাকে, ওপরের পাটিতে ১৬ টি ও নীচে ১৪ টি । তার দাঁতের ফর্মুলা ( যে কোনো প্রজাতির প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যের দাঁতের কাউন্ট ) ওপরের চোয়ালে ৩/১/ ৩ /১ ও নীচের চোয়ালে ৩/১/২/১ , অর্থাৎ মুখের একদিকের ( একটি quadrant এর হিসেবে ) ওপরের maxilla তে তাদের তিনটি ইনসিজার, একটা ক্যানাইন, তিনটি প্রিমোলার ও একটি মোলার। দুই দিক মিলিয়ে তা দাঁড়ায় ষোলোটি দাঁতে। নীচের দিকের mandible এর একটা অংশ ধরলে দাঁড়ায় তিনটি ইনসিজার, একটি ক্যানাইন,দুটো প্রিমোলার ও একটি মোলার, অর্থাৎ সাতটি দাঁত। দুই দিক মিলিয়ে সংখ্যাটি ১৪ টি দাঁত।
অল্প বয়সে তার দাঁতের রং সাদা, ক্রমে, বয়স বৃদ্ধির সাথে তা হলদেটে হতে থাকে।
ভীতিউদ্রেককারী ওই বিশাল হাঁ মুখের মধ্যে থাকে দু দিকের দুটি করে লম্বা, বাঁকানো ক্যানাইন দাঁত। লম্বায় তা প্রায় দুই থেকে তিন, সাড়ে তিন ইঞ্চি হয়।বেড়াল পরিবারের মধ্যে বাঘের ক্যানাইন দীর্ঘতম। ক্যানাইনের সাহায্যে বাঘ দাঁত বসায় শিকারে,ঘাড় ধরার চেষ্টা করে।
সুন্দরবনে সংঘাত মুহূর্তে আক্রান্ত বা প্রত্যক্ষদর্শী বয়ানে বারবার উঠে আসে তার ভয় জাগানো ক্যানাইন বা খিলান দাঁতের কথা। খিল দেওয়া বা লক করার মতোই খিলান / খিলেন দাঁত চেপে ধরে আক্রান্তের ঘাড়।
বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় বাঘে ধরা আক্রান্তের ঘাড়ে গভীর গর্ত হয়ে গেছে, সে ছিদ্রে সহজে হাতের আঙ্গুলও ঢুকে যেতে পারে। শিকারকে pierce বা বিদ্ধ করে immobilise করে ফেলার কাজ এই দাঁত দিয়ে সম্পন্ন করা হয়। শিকারের গলা বা ঘাড়ে ছিদ্র করে স্পাইনাল কর্ড বা মেরুদণ্ড snap করা বা ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয় ক্যানাইন দাঁতের জোরের কারণে।
হাত, পা, কাঁধ, বুকে প্রথম কামড় বসানোর পরেও আক্রান্ত বেঁচে ফিরে আসতে পারে, কিন্তু ঘাড়ে ক্যানাইন বা খিলান দাঁত বসিয়ে দিলে, সাধারণত নিস্তার পাওয়া যায় না। সেই অবস্থায় বাঘ দু তিনবার শিকার মুখে নিয়ে ঝাঁকুনি বা ঝাড়া দেয়, বাদায় সেই ঝাঁকুনির নাম ‘ নাকড়ান’ । দাঁতের ভেতরে থাকা pressure sensing nerves বা একধরনের স্নায়ু থাকে, যা দিয়ে বাঘ শিকারের আঘাতস্থানে ঠিক কতটা চাপ দিলে শিকারকে বাগে রাখতে পারবে, তার আন্দাজ পায়।
খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঘকে নিয়ন্ত্রণ করার একাধিক মন্ত্রের অন্যতম বাঘের খিলান মন্ত্র। এই মন্ত্র কাজের খুব কাছাকাছি জায়গায় বাঘের অবস্থান থাকলে কার্যকরী হয় , চলতি কথায় তাকেই বাঘের মুখ বন্ধ করা বলা হয়। ভাবা হয় চত্বরে বাঘ থাকলেও, সে মানুষের গায়ে আসতে পারে না, ক্ষতি করতে পারে না। খিলান মন্ত্র নিয়ে মত বিভক্ত, জঙ্গলের যে কোনো বন্যপ্রাণের স্বাভাবিক আচরণ রুদ্ধ করা , প্রাচীন বনদর্শনের পরিপন্থী। মা বনবিবি , মা বিশালক্ষ্মীর প্রতি আস্থাজ্ঞাপন যথেষ্ট – গাছ, পশু, পাখির ক্ষেত্রে প্রকৃতির ওপর অস্বাভাবিক হস্তক্ষেপ কাম্য নয় – সেই হিসেবে খিলান মন্ত্রের ব্যবহার জঙ্গলদর্শনের এক মতে সিদ্ধ নয়।
এছাড়া থাকে ছোটো, chisel আকৃতির incisor দাঁতের সারি।শিকার ধরা, হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে নেওয়া বা বড়ো শিকারের লোম,চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এই দাঁত গুরুত্বপূর্ণ। হাড় থেকে মাংস scrape করে নেওয়াতে এই দাঁত কার্যকরী।
ক্যানাইন ও পেছনের দাঁতের মধ্যে একটি স্পেস বা ফাঁক থাকে, যাকে diastema বলা হয়। এই গ্যাপের মাধ্যমে বাঘ তার শিকার ভালো করে গ্রিপ করতে পারে।
তার পেছনে থাকে প্রিমোলার ও মোলার দাঁতের সারি। এই দাঁতগুলো শিকার ছেঁড়া ও চিবিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে উপযোগী। মাংস ফালা করা বা কাঁচির মতো shear করার ক্ষেত্রে এই দাঁতের ব্যবহার।
ওপরের চোয়ালের শেষ প্রীমোলার ও নীচের চোয়ালের প্রথম মোলার দাঁতের অংশে থাকে carnassial দাঁত যার সাহায্যে বাঘ শিকারকে shear করে বা ছাড়ায়, শিকারের মাংস ও পেশী ফালা ফালা করে দেয়। নীচের চোয়ালের সাথে একযোগে কাজ করে এই carnassial দাঁত, দ্রুততা ও পরিচ্ছন্নতার সাথে খাওয়া সম্পন্ন হয়।এই দাঁতের ব্যবহার ছুরির মতো, বাঘ তা দিয়ে শিকারের মাংস ফালা ফালা করে।
******
বাঘ – মানুষ সংঘাতে আক্রান্ত মানুষের অভিজ্ঞতা বা মৃতদেহ দর্শন তার দাঁতের ভয়াবহতার ধারণা তৈরি করে জনমানসে। সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে, যে কোনো বাঘের জঙ্গল লাগোয়া বসতিতে সাধারণ মানুষের মনে বাঘের দাঁত সংগ্রহের প্রতি ঝোঁক দেখা যায়, বিশ্বাস করা হয় তার অলৌকিক ক্ষমতায়। চামড়া, নখ, শরীরের internal organ এর মতোই বাঘের দাঁত শক্তিবর্ধক হিসেবে গণ্য করা হয়। ‘ফোকলোর ‘ বা কালচারাল স্টাডির চর্চায় দেখি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বাঘের দাঁতের প্রতি কৌতুহল, চাহিদা। প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে চায়না, মধ্য/ দক্ষিণ আমেরিকার একাধিক নিদর্শন মনে করিয়ে দেয় বাঘের দাঁত, তাকে ঘিরে সংগঠিত বিস্বাসরীতির অন্যতম উপাদান। উত্তরে সাইবেরিয়া বা দক্ষিণ পুবে জাভা, মধ্য ভারতের বাঘবন বা আমাদের সুন্দরবন, মাদুলি, হার, তাবিজ হিসেবে তার ব্যবহারের প্রচলন আছে – কালো জাদু থেকে সুরক্ষা, আধ্যাত্মিক যোগযোগ, তন্ত্র মন্ত্রে দাঁতের ব্যবহার দেখা যায়। সুন্দরবনে এক সময়ে গ্রামে ওঠা বাঘের জঙ্গল ফেরা হতো না। মৃত বাঘের গা থেকে নখ, চামড়া, গোঁফের মতোই দাঁতও কেটে, ভেঙে নেওয়া হতো। সংরক্ষণের আমলে তা বন্ধ, কিন্তু পূর্বতন আমলের স্মৃতি হিসেবে আবাদে বহু মানুষের কাছে এমন কিছু ‘রেলিক ‘ রয়ে গেছে সংগ্রহে।
মানুষ ধরা বা মানুষখেকো বাঘেদের অনেকেই দাঁত ভাঙা, নষ্ঠ হয়ে যাওয়া – এমন একটা পর্যবেক্ষণ করা যায়। সুন্দরবন ও অন্য বাঘবনের বিশেষ পরিচিত একাধিক প্রবলেম টাইগারদের ক্ষেত্রে শারীরিক আঘাত, অসুস্থতা, পায়ে, চোখে বা মেরুদণ্ডে সমস্যা দেখা যায়। সুন্দরবনে বারংবার পেরিয়ে আসা বাঘেদের মধ্যে দেখা গেছে অনেকেরই সমস্যা দাঁতের, বয়স বা আঘাতজনিত কারণে শিকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা বাঘেরা প্রায়ই পেরিয়ে এসেছে লোকালয়ে।
সুন্দরবনে বাঘের দেখা মাঝেমধ্যে পাওয়া গেলেও বিপদ ও ঘনত্বের কারণে ট্র্যাপ ক্যামেরা ব্যতীত বাঘের শিকার করার, শিকার ধরার মুহূর্ত দুর্লভ। ফলে, বাঘের দাঁতের ছবিও অন্য জঙ্গলের মতো বিশেষ দেখা যায় না। সাম্প্রতিক অতীতে শিকারের মুহূর্তের এমন দুটি ছবির কথা মনে পড়ে – তবে তার কোনোটিতেই বাঘের দাঁত দেখা যাচ্ছে না। বরং, ফ্লেহমেন রেস্পনসের কিছু ছবির ডকুমেন্টেশন আছে যাতে তার ক্যানাইন দেখা যাচ্ছে। আর আছে কিছু ছবি যেখানে সামনের ক্যানাইন প্রদর্শিত আছে।
******
তাই, বাঘের দাঁত তার শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কারদের অন্যতম। তার শরীরের গঠনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর একটি তার দাঁত। তার শিকার পদ্ধতি, খাওয়ার ধরন জানা যায় দাঁতের গঠন ও ব্যবহার থেকে। গবেষণার জগৎ, সংরক্ষণের জগৎ তো বটেই, লোকসংস্কৃতিতে বাঘের দাঁতের বিশেষ স্থান আছে, তা বলাই বাহুল্য। জীববিজ্ঞানের ধারায়, বিবর্তনের ধারায় সুন্দরবনের জঙ্গলের শ্রেষ্ঠ সম্পদকে জানতে গেলে তার দাঁতের কথা জানতেই হবে।
*******
এবারের বাঘের ছবির নিবেদন রেখেছেন সুন্দরবনের অভিজ্ঞ গাইড Mrityunjay Mandal। জঙ্গলে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে চলেছেন বহু বন্যপ্রেমী। বাঘ ও অন্য বন্যপ্রাণের একাধিক দুর্দান্ত মুহূর্ত তাঁর সংগ্রহে।
তার পরের ছবিটি Khasru Chowdhury বাবুর উপহার। তিনি আমাদের অগ্রজ বনচারী, শিক্ষক । সুন্দরবনে সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্বল তাঁর, আমাদের আদানপ্রদানে সর্বদা বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত।
তার পরের ছবি ও মডেলের ছবি সংগৃহীত।
লেখক: উদ্দালক দাস
Comment (0)